ফজলুল কবির গামা : ‘রাত আড়াইটা, হঠাৎই এক ব্যক্তি মোবাইলে ফোন করে বলে আপনার স্বামী রিপন মেম্বারকে হত্যা করা হয়েছে। রাস্তার পাশে পড়ে আছে। এসে নিয়ে যান। তখন গিয়ে দেখি রিপন রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে শেষ রক্ষা হয়নি। সকালেই মারা যান তিনি।’ দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে এমনটিই বলেছেন নিহত আওয়ামী লীগে নেতা হাবিবুর রহমান রিপনের স্ত্রী তানিয়া খাতুন। স্বামী হত্যার বিচার চেয়েছেন তিনি। রিপন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। তার বাড়ি উপজেলার মীনগ্রামে। তানিয়া খাতুন উপজেলার মীনগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। মঙ্গলবার দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলালের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশের অভিযোগ এনে ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবে শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগ এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে লিখিত বক্তব্য দেন নিহত হাবিবুর রহমান রিপনের স্ত্রী তানিয়া খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাকিম আহমেদ, নিহতের পিতা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ অন্যরা। তানিয়া খাতুন বলেন, আমাদের পরিবার স্বাধীনতার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে শ্বশুর আবুল কালাম আজাদ আবাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আমার স্বামী শ্বশুরের সঙ্গে বাড়ির জমি দেখাশোনা করতেন। কিন্তু প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঘায়েল করতে কিছু বিএনপি ও নব্য আওয়ামী লীগ নেতারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। শুনেছি এক সময় বিএনপি করলেও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদ পেয়েছেন বিশ্বাস বিল্ডার্সে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম দুলাল। পদ পাওয়ার পর অন্যদের সঙ্গে নিয়ে উপজেলায় তার অবস্থান শক্ত করতে প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন। আমার স্বামী হাবিবুর রহমান রিপনকে তারা পিটিয়ে হত্যা করেন। তানিয়ার দাবি, মৃত্যুর দুই থেকে তিন মাস আগে তারা বিভিন্ন সময় রিপনকে হত্যার হুমকিও দিত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে মীনগ্রাম বাজারে তাকে আক্রমণও করে। তখন বেঁচে গেলেও এবার বাঁচতে পারেনি আমার স্বামী। মামলার পর কিছু আসামি জামিন পেয়ে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় নজরুল ইসলাম দুলালের বাসায় বৈঠক করে। আমরা জানতে পারি পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যার নির্দেশে ছিলেন নজরুল ইসলাম দুলাল ও তার ভাই আবাইপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বিশ্বাস। এ পরিকল্পনা তাদের বাড়িতেই হয়েছিল। রিপনের স্ত্রী আরও বলেন, তিন মাসের শিশু তাবিব আহনাফ ও পাঁচ বছরের শিশু আবিদ আহনাফ তারা এখনো জানে না তাদের বাবা আর কখনো ফিরে আসবে না। এখন বড় ছেলে বলে মা বাবা কোথায় গেছে। কিন্তু তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারি না। বর্তমানে শিশু দুটি খুবই অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে। তিনি বলেন, ঘটনার পর সুজন নামের এক ব্যক্তি ফোন করে বলে রিপন মেম্বারকে মেরে ফেলা হয়েছে এসে নিয়ে যান। জামিন পাওয়া আসামিরা এখন আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে থানায় একটি অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। রিপন হত্যার নির্দেশদাতাসহ অন্যদের সঠিক বিচার চাই। শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঠাকুরদাস মন্ডল বলেন, মামলার পাঁচজন ব্যতীত সব আসামি জামিনে আছেন। তদন্ত শেষে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হাকিম আহমেদ বলেন, মূলত তার পরিবারের সংবাদ সম্মেলন। এটাকে সমর্থন জানিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। অভিযোগের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বলেন, এলাকার মানুষ বিভিন্ন সময় আমার কাছে আসে, আমি সহযোগিতা করি। তারা জামিনে মুক্ত হয়ে অফিসে এসেছে এটা দোষের কিছু না। তারা তো দোষী প্রমাণিত হয়নি। রিপন ঘটনাস্থলে মরেছিল নাকি হাসপাতালে আনার পথে যারা সঙ্গে ছিল তারা মেরেছে। এটা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। সামনে নির্বাচন, আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী, এখন এমন নানা ষড়যন্ত্র হতেই থাকবে। তবে রিপন হত্যায় জড়িতরা শাস্তি পাক এটা আমি নিজেও চাই। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল হাই সমর্থক হাবিবুর রহমান রিপন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী নজরুল ইসলাম দুলালের সমর্থকদের মধ্যে। এ দ্বন্দ্বের জেরে ১৬ অক্টোবর ভোরে আবাইপুর বাজার পার হলেই প্রতিপক্ষের সমর্থকরা হাবিবুর রহমান রিপনকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন। সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকালেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর নিহতের সমর্থকদের অর্ধশতাধিক বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরদিন নিহতের ভাই বাদী হয়ে শৈলকুপা থানায় ৩২ জনের নামে এবং অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তবে এ মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম দুলাল ও ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বিশ্বাসের নাম নেই। তবে মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়।
Discussion about this post